Tuesday, December 13, 2011

এ জার্নি বাই সুইস ট্রেন


লুজান থেকে জেনেভা আসার ট্রেন আসতে দুই মিনিট ২০ সেকেন্ড সময় আছে এরই মাঝে টিকিট কাটতে হবে। থিউডোরাকে বললাম তুমি দাড়াও আমি দৌড়ে গিয়ে ঠিকই এই সময়ে টিকিট কেটে চলে আসব। থিউডোরা আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলে আমার সাথে যেতে তোমার টিকিট লাগবেনা। আমি বললাম আরে না না গরিব দেশের লোক হতে পারি অন্তত টিকিট কাটার টাকা আছে আমার, বলতে বলতে টিকিট কাউন্টারের দিকে ছুটে যাব এমন সময় থিউডোরা গোলা উঁচু করে বলে [I am telling you believe me! You don’t need a ticket if you are with me! Come back please]জানতে চাইলাম কি স্টোরি! সে বলে আগে ট্রেনে উঠো তারপর বলছি

ট্রেনে উঠলাম টিকিট ছাড়া! কিছুক্ষণ পর টিকিট চেকার আসতেই থিউডোরা তার ব্যাগ থেকে কিছু একটা বের করে দেখাতেই চেকার হাসি মুখে ‘বন ভইয়াজ’ বলে চলে গেল। আমার কৌতুহল আরও এক দফা বেড়ে গেল। জানতে চাইলাম কি রহস্য বল। তোমার কার্ডে এমন কি আছে যে সাথে কেউ থাকলেও তার ভাড়া লাগেনা। সে বলে আগে বল গল্প শোনার পর কোন রকম করুনা করতে পারবানা, আমি বললাম করুনা !! তাও আবার তোমাকে! তুমি তো সুইজারল্যান্ডের লেডি ডন। সে হাসি দিয়ে গল্প শুরু করলো এরই মাঝে ট্রেন ও ধীরে ধীরে চলতে শুরু করলো

ছোট বেলা থেকেই আরসেন কে থিউডোরার  ভাল লাগে! বিশেষ করে আরসেন ক্লাসের অন্য সব ছেলেদের চেয়ে অনেক আলাদা, ডার্টি জোকস- ক্লাসের মেয়েদের ফুসলিয়ে নাইট ক্লাবে নিয়ে যাওয়া এইসবে আরসেনের তেমন কোন আগ্রহ নেই। আরসেনের ভাল লাগে গিটার বাজাতে স্কি করতে আর হাতে গুনা অল্প কিছু বন্ধুর সাথে আড্ডা দিতে। থিউডোরার ঠিক একই বিষয় ভাল লাগে তবে গিটার তার কাছে কঠিন লাগে তাই থিউডোরা ভায়লিন বাযাতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
কোন এক বিকেলে আরসেন থিউডোরাকে একটা সঙ্গীত সঙ্ঘে নিয়ে যায়। দর্শকদের গ্যলারিতে থিউডোরাকে রেখে হটাত আরসেন উধাও। থিউডোরা এদিক ওদিক খুঁজতে থাকে আরসেনকে। হটাত আবিস্কার করে সঙ্গীত শিল্পীদের মাঝে লিড গিটার নিয়ে আরসেন বসে আছে! এটা ছিল থিউডোরাকে দেয়া আরসেনের প্রথম সারপ্রাইজ। সঙ্গীত সন্ধ্যা শেষে জানিয়ে দেয় এই জাতীয় সারপ্রাইজ আরও অনেক পেতে চায় সে! আরসেন বলে তা হলে তো আমাদের একই সাথে থাকতে হবে। দু দিন সময় নিয়ে থিউডোরাকে জানিয়ে দেয় তার বাবা মাকে সে আরসেনের সাথে থাকতে চায়। তারপর শুরু এক সাথে পথ চলা। হাসি কান্না মান অভিমান সারপ্রাইজ সহ আরও অনেক কিছু। সময় গড়ায় থিউডোরার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রস্তাব আসে ভারতের আই আই টি তে পড়তে জাবে কিনা একচেঞ্জ স্টুডেন্ট হিসাবে। কাছের বন্ধুরা সবাই যাচ্ছে তাছাড়া ইঙ্ক্রিডিবল ইন্ডিয়ার বিজ্ঞাপন প্রায় দেখায় টিভিতে।


আরসেন কে ইচ্ছার কথা জানাতেই আরসেন ভাবে একটা ছোট খাট ব্রেক হলে খারাপ হয়না তাছাড়া আরসেনের ও ইচ্ছে ফ্রন্সের মার্সেই থেকে অর্কেস্ট্রার উপর একটা কোর্স করা। তবে দুজনই ঠিক করে যেকোন অবস্থাতেই হোক অন্য কোন রিলেশনশিপে জড়াবে না । এবং ফিরে এসে প্রথমে একটা বাচ্চা নিবে তারপর ইচ্ছে হলে ‘বিয়ে’ না হলে নাই [ প্রসঙ্গত বলে রাখি সুইজারল্যান্ডে আশির দশকের পর বেশির ভাগ বিয়েই বাচ্চা হবার পর কিংবা বাচ্চা আছে কিন্তু বিয়ে করেনি]। ছেলে হলে ‘ইউলিস’ আর মেয়ে হলে ‘ফ্লরিয়ান’ এই দুইটা নাম ঠিক করে আরসেন আর থিউ ডোরা মিলে।
২০০৯ সালের শুরুর দিকে থিউডোরা ভারত আর আরসেন মার্সেই চলে যায় যে যার কাজে। ভালই যাচ্ছিল থিউ ডোরার দিন গুলো। সারাদিন ক্লাস সন্ধ্যায় আড্ডা আর উইকএন্ডে ভারতীয় নাচ‘ ভাঙরা’ শিখে। মাঝে মাঝে আরসেনের সাথে কথা হয় স্কাইপে। এভাবে একদিন দীপালির উৎসবের রাতে বন্ধুদের সাথে আতশ বাজী নিয়ে আনন্দে মেতে উঠে। বেশ কটা বাজী ফুটানোর পর একটাতে কি সমস্যা ছিল যে ফুটছে না,  কাছে থেকে দেখতে গিয়েই ডেকে আনে বিপদ। চোখের কাছে আনতেই বিকট শব্দ করে ফুটে উঠে আতশ বাজিটি আর সাথে সাথেই এক ধরনের তীব্র ব্যথা অনুভব করে থিউডোরা আর বাকীটা তার মনে নেই জ্ঞান ফেরার পর দেখে সে হাসপাতালে পাশে বন্ধুরা ছিল কিন্তু তারপরও তাদের কাউকেই সে দেখতে পায়না। ডাক্তার বেশ কিছু চেক টেক করে সুইজারল্যান্ডে রেফার করে দিল। কোর্স শেষ না করেই ফিরে আসতে হল থিউডোরাকে। সুইজারল্যান্ডের ডাক্তার দুই সপ্তা ধরে অনেক রকমের চেক করে ব্যনদ্যাজ খুলে দিতেই ২ সপ্তাহ পর আবার এই সুন্দর পৃথিবী দেখতে পায়।

সব কিছুই আগের মতো তার মানে তো আমি ভাল হয়ে গেছি! কিন্তু না, বেশ কয়েক ঘণ্টা পর মাথায় এক ধরনের ব্যথা অনুভব করে সে। ডাক্তার এটা নিয়েই খুব চিন্তিত ছিলেন। পরবর্তীতে ডাক্তার বুঝিয়ে বলেন সমস্যাটার কথা। অন্তিরিক্ত রক্তক্ষরণ হবার কারনে মস্তিস্কের কোন একটা নার্ভ অকেজো হয়ে যাচ্ছে। দুর্ভাগ্য জনক হলেও সত্য এই রোগটার কোন ঔষধ এখনো বের হয়নি। এভাবে চলতে থাকলে খুব জোর ২/ত বছর পর থিউডোরা আর কিছুই দেখতে পারবেনা
গল্পের এই পর্যায়ে আমি জানতে চাই আরসেনের অনুভুতি কি ছিল? সে হাসি দিয়ে বলে আরসেন আমার চেয়ে অনেক বেশি শক্ত মনের মানুষ। হাসপাতাল থেকে ফিরে কিছুদিন পর আরসেন আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। আমি বেশ কবার মানা করেছি। আমি নিজেও ভেবে পাইনা একটা অন্ধ মেয়েকে নিয়ে সে সারা জীবন থাকবে কি ভাবে? আরসেন নাছোড় বান্দা তাই বিয়েতে রাজি হয়েছি। ২০১০ এর শুরুর দিকে আমরা বিয়ে করেছি। আর আমার ছেলেকে তো তুমি দেখেছই হাসপাতালে দুই মাস আগেসুইজারল্যান্ড সরকার অন্ধ-প্রতিবন্দি দের জন্য বিশেষ টিকিটের ব্যবস্থা রেখেছে যা দিয়ে প্রতিবন্দি মানুষটির সাথে তার কেউ সাহারা হলে সেও বিনা টিকিটে চড়তে পারবে। আমি অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আজ এই সুবিধা পেলাম। যদিও থিউ ডোরা এখনো পুরপুরি অন্ধ হয়নি তারপরও সে এই সুবিধা পাবে। থিউডোরার গল্প শেষ এদিকে ট্রেন লুজান থেকে জেনেভা চলে এসেছে এবার বিদায়ের পালা, ‘ থাঙ্কস ফর এভ্রিথিং উই সি ইচ আদার এগেইন বলে চলে এসেছি’

গত দুই মাস আগে থিউডোরা ছোটো একটি দেব শিশুর মা হয়েছে শিশুটির নাম ইউলিস। আমি দুই মাস আগে ইউলিস কে দেখতে গিয়েছিলামতখনো জানতাম না থিউডোরা আর কয়েক বছর পর এই দেব শিশুটিকে দেখতে পাবেনা।

No comments: