Tuesday, April 10, 2012

আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

ইস্টারের ছুটিতে লিয়ন গিয়েছিলাম আমার ল্যাবম্যাটদের সাথে, ফ্রান্সের শহর লিয়ন থকে জেনেভা ফিরছি আমার প্রফেসর ইমানুয়েল আর আমি এক গাড়ীতে, বাকিরা ভাগ ভাগ করে একেকজন একেকজনের গাড়ীতে। সিট বেল্টটা বেঁধেই ইমানুয়েল গাড়ীর মিউজিক প্লেয়ারটা অন করে দিল। গাড়ী ঘণ্টায় ৮০ কি. মি. বেগে চলছে মিউজিক প্লেয়ারে রামস্টেইন ব্যান্ডের গান বাজছে “ দু- দু হাস্ত- দু-হাস্ত মেইস” [you-you have hate-you have hate me ]। এমনিতে জার্মানির হেভিমেটাল ব্যাণ্ডগুলোর গান খুব ভালো লাগে কিন্তু রাস্তায় হার্ডরক গান শুনতে কেমন এক ধরনের ভয় ভয় লাগে এক্সিডেন্টের কথা ভেবে ।

প্রফেসর ইমানুয়েল কে বললাম ভলিউমটা কি একটু কমানো যায়? সে কি মনে করে বলল তোমার সেলফোনে কি তোমাদের দেশের গান আছে? আমি চেক করে দেখলাম সর্বসাকুল্যে ৯ টা গান আছে রবীন্দ্রসঙ্গীত, শ্রীকান্ত আচার্য্য আর দুইটা দেশাত্মবোধক গান । আমার সেলফোনটা নিয়ে প্লাগইন করতেই কোমল সুরে বাংলা গান বাজতে শুরু করল

“গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙা মাটির পথ
আমার মন ভুলায় রে ”

লিয়ন থেকে জেনেভা আসার রাস্তাটা খুব স্ত্রেইট একটানা লম্বা সময় ধরে তাকায়ে থাকলে আমার চোখে কেমন এক ধরনের ক্লান্তি চলে আসে।গানের সাথে সাথে আমি ঘুমিয়ে পড়ছি । ঘোরের মাঝে দেখি বড় আপা আমার গালে হাত দিয়ে চুল আঁচড়ায়ে দিচ্ছে। কিছুক্ষণ পর আমরা পাশের বাড়ীতে বেড়াতে যাব আপা রাগী রাগী গলার প্রশ্ন করছে, 'কি কি শিখালাম এক এক করে বল' । আমি বললাম,

[১] বিস্কুট একটা বা দুইটার বেশি খাওয়া যাবেনা ।

[২] চা পিরিচে করে খাওয়া যাবেনা ।

[৩] মুরুব্বীরা কথা বলার সময় কথা বলা যাবেনা ।

আপা বললেন ঠিক আছে, আসলে আপা শিখায়ে দেয়ার আগে আমি কারো বাসায় বেড়াতে গেলে চা বিস্কুট খেতে দিলে, খাওয়া শেষে আসার পথে বিস্কুট যে পিরিচে দেয়া হতো- তার সবগুলো আমার ক্রিকেট খেলার বন্ধুদের জন্য পকেটে করে নিয়ে আসতাম, যেটা একদিন আপা জানার পর কঠিন শাস্তি পেয়েছিলাম কারন আপার চোখে এটা ভদ্রতার আওতায় পড়েনা।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যেমন চা পানের বিরতি থাকে,তেমনি ভাবেই আমাদের ক্রিকেট খেলার এক ইনিংসের পর আমরা সবাই চা খেতে পাড়ার মোড়ে দুই দল পরস্পর থকে কিছুটা দূরত্ব রেখে চা খেতাম। আর পরের ইনিংসের ব্যাটিং/ বোলিং এর পরিকল্পনা করতাম । পরিকল্পনা পর্বটা খুব উত্তেজনার ছিল। তাই দোকানের অন্য লোকদের দেখাদেখি আমিও তপ্ত চায়ে ঠোঁট পুড়ে যাওয়ার থেকে রক্ষা পাবার জন্য চা পিরিচে ঢেলে নিতাম, যেটা আপার চোখে “ ভয়ানক অভদ্রতা” পর্যায়ের।

ক্রিকেট খেলতে গেলে মাঝে মাঝে মারামারি বেধে যেতো। শারীরিক গঠন মাঝামাঝি ছিল বলে কোন কোন দিন মার দিতাম কোন কোন দিন মার খেয়ে বাসায় ফিরতাম। মার দেই আর মার খাই মারামারি করেছি শুনলেই আর আমার নিস্তার নাই, বাসায় আসলে আপার হাতে আবার মাইর। আপার হাতে মার খেতে যতটা না খারাপ লাগতো তারচেয়ে বেশি খারাপ লাগতো মার খাওয়ার পর, ছোটবোন মুচকি মুচকি হাসতো দেখে। ইচ্ছা করতো এক চড়ে দাঁত ফেলে দেই তার ও উপায় নেই কারন বাসায় “মার্শাল ল” সামান্য মুচকি হাসির জন্য চড় দেয়া যাবেনা। এভাবে একদিন SSC HSC পরীক্ষা শেষে আপা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চলে যায় । বিকালে খেলাধুলা শেষে আপার ঘরটাতে কেমন খালি খালি লাগতো প্রথম দিকে, মনে হতো কিছুক্ষণ পরই আপা আসবে আজ কেউ বিচার দিল কিনা তার হিসাব কিতাব করতে।


এবার ভাইয়ার গল্প। আপার অনুপস্থিতিতে ভাইয়ার হাতে “পাওয়ার অফ এটর্নি” থাকত কারন আমাদের বাসায় অনেকটা ‘মার্শাল ল’ টাইপ ব্যাপার ছিল বয়স অনুযায়ী চেইন অফ কমান্ড, তবে ভাইয়া খুব বেশি মারত না সবচেয়ে বেশি মার খেয়েছি স্কুলের ক্লাস ফাইভের অঙ্ক স্যারের হাতে। বেশ কিছু দিন মার খাবার পর অবশ্য আমার সহ্য হয়ে গিয়েছিল। তারপর ও হঠাত্‍ করে আজ স্যারের চেহারা মনে হতেই পিঠটা কেমন করে উঠল।

সবচেয়ে বিরক্ত লাগতো স্যারকে কোন প্রশ্ন করলেই স্যার রাগ দেখাতেন। যেমন একদিন বানরের তৈলাক্ত বাঁশে উঠানামার অংকটা আমার কাছে আজব লাগে বলে স্যারকে প্রশ্ন করেছিলাম স্যার বানর তো এত বোকা না যে তৈলাক্ত বাঁশে উঠবে আর বানরতো গাছে গাছে থাকে বাঁশ গাছে আমি কোনদিন বানর দেখিনি। ক্লাসের অন্য দুইজন জোরে হেসে উঠার সাথে সাথে স্যার বিদ্যুৎ গতিতে একটা চটাশ থাবড়া বসায়ে দিলেন আমার গালে। উদ্ভট প্রশ্ন করার কারনে আমার আর বৃত্তি পরীক্ষার বাছাই পর্বে চান্স পাওয়া হলনা। কিন্তু প্রশ্নটা প্রায় আমার মাথায় ঘুরাঘুরি করতো বানর কেন তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে উঠতে যাবে।

ভাইয়াকে ও একই প্রশ্ন করাতে ভাইয়া হাসি দিয়ে এইটা আসলে রূপক অর্থে বলে অঙ্কটা বুঝিয়ে দিল । কোন বিচিত্র কারনে ভাইয়া যে জিনিসগুলা সাপোর্ট করতো আমিও তাই সাপোর্ট করতাম, ফুটবলের উত্তেজনা তখন প্রায় শেষের দিকে ভাইয়া আবাহনী সাপোর্ট করতো তাই আমিও সাপোর্ট করতাম। এক সময় ভাইয়া গণতন্ত্র ভালো না সমাজতন্ত্র ভাল বলল, আমি ও বন্ধুদের সাথে আলাপ করতাম সমাজতন্ত্রই ভালো আসলে আমি সমাজতন্ত্র বিষয়টা কি এইটাই ভাল মতো বুঝতাম না (এখনো ভালো মতো বুঝিনা..)

H.S.C পরীক্ষার পর ভাইয়া বিমানবাহিনীতে ঢোকার জন্য নানা রকম ব্যায়াম সামগ্রী কিনে এনে কঠিন ব্যায়াম শুরু করে দিল সাথে আমি ও টুকটাক চেষ্টা করতে লাগলাম। I.S.S.B না কি যেন একটা পরীক্ষা দিতে ভাইয়া প্রথম বাসা থেকে বের হয়। স্কুল কলেজের রেজাল্ট, শারীরিক গঠন সব মিলায়ে আমরা সবাই ভাবতাম ভাইয়া চান্স না পেলে আর কে পাবে ! তার উপর ভাইয়া যেদিন থেকে পরীক্ষা দিতে গেছে সেই দিন থেকে থেমে থেমে বৃষ্টির মতো আম্মার নফল নামাজ পড়া দেখে আমি মনে মনে ঠিক করে ফেলেছিলাম ভাইয়া অবশ্যই চান্স পাবে।

এটাও ঠিক করেছিলাম ভাইয়া বিমানবাহিনীতে ঢুকার পর পাড়ার পাতি মাস্তান গুলার পিঠের ছাল তুলে নিব। আগে যত মাইর খাওয়া আছে সব শোধবোধ। কিন্ত আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে ভাইয়া পরীক্ষার শেষ দিন ভেজা চোখে ফিরে এসে আম্মাকে জানাল তার আকাশে উড়ার স্বপ্ন কোনদিন পূরণ হবেনা। আমারও পাতি মাস্তানদের পিঠের ছাল তুলে নেয়ার স্বপ্নটা অপূর্ণই রয়ে গেল।



অতঃপর কোন এক দুপুরে আপার মতো ভাইয়া ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে বাসা থেকে হলে চলে গেল । আমার রাজ্যে আমি একা শাসন করার কেউ নেই। কিছুদিন একা থাকার পর কেন যেন আর ভাল লাগতোনা, মনে মনে চাইতাম ভাইয়া আপা আবার বাসায় চলে আসুক, কিন্ত সেভাবে আর কোনদিন ফিরে আসা হয়নি তাদের । বিদেশে পাড়ি দেবার আগে ঈদে আমাদের সবার দেখা হতো কিন্তু এখন এই সুযোগটাও নেই একেক জন একেক মহাদেশে থাকি, আমার পরীক্ষা ভাইয়া আপার বাচ্চাদের স্কুল হরেকরকম ব্যস্ততা।

এলোমেলো ভাবতে ভাবতে আমরা জেনেভা চলে এসেছি। ইমানুয়েল আমাকে বলল, 'তোমাদের দেশের গান তো খুব সুন্দর আমাকে কাল একটা কপি দিও।' মাঝে মাঝে বাজাবো। আমি হাসি দিয়ে সম্মতি দিয়ে বিদায় জানিয়ে বাসায় ফিরে আসি ।

প্রতিবার দেশে গেলে আমি আমার ফেলে আসা দিন গুলাকে খুঁজে বেড়াই। আমার স্কুল, ধুলোমাখা গিটার আর যত্ন করে রাখা ক্রিকেটের ব্যাট। মাঝে মাঝে পথ চেয়ে থাকি ভাইয়া, আপা, আমরা সবাই কোন একটা দিন সেই পুরোনো দিনগুলোতে ফিরে যাবো । গাড়ীতে বাজতে থাকা গানগুলার একটার কথা ছিল অনেকটা এরকম :

“আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ
খেলে যায় রৌদ্র ছায়া
বর্ষা আসে বসন্ত
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ”
............... ............... .......

সময়ের প্রয়োজনে আমরা আজ একেক জন একেক মহাদেশে থাকি।
হয়তো কোনদিন সবার এক সাথে ফেরা হবেনা তারপর ও আমি পথ চেয়ে থাকি...