কোথায় যাচ্ছ ভেকেশনে? মে মাস শুরু হতেই এই প্রশ্ন প্রতিদিন আমার কলিগদের মুখে মুখে থাকে। আমাদের দেশের দুর্নীতিবাজদের যেমন প্রতি বছর ওমরাহ্ হজ্জ্বে যাওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ, সুইসদের কাছে ভেকেশনে যাওয়াটা অনেকটাই সেরকম। চলুন এই সামারে আপনাদের সুইজারল্যান্ড নিয়ে যাই, আজকের গন্তব্য জেনেভা।
ধরে নিচ্ছি আপনি সকাল ৯ টা/১০ টার দিকে এয়ারপোর্টে নামলেন। এবার ৭ সুইস ফ্রাঙ্ক দিয়ে একটা ট্যুরিস্ট টিকেট কিনে নিন, এটা দিয়ে আপনি জেনেভা শহরে ট্রেন, বাস, ট্রাম, বোট সব চড়তে পারবেন। তারপর এয়ারপোর্ট থেকে যে কোন ট্রেন দিয়ে জেনেভা সেন্ট্রাল ট্রেনস্টপে চলে আসুন। এবার ১৩ নাম্বার ট্রামে করে নেশন্স ডাইরেকশনে ২ স্টপ সামনে আসুন, ষ্টেশনের নাম Bellevu। এবার বামের গলি দিয়ে একটু সামনে এলে “Youth Hosteling“ সাইন দেখতে পাবেন। আমার জানামতে এটাই জেনেভা শহরের সবচেয়ে সস্তা হোটেল, আসলে হোটেল বলা ঠিক হবেনা, কারন “Youth Hostel” শুধু রাতে ঘুমানোর জন্য। অনেকটা ঢাকা শহরের চিৎ কাইত হোটেলের মত। প্রতিরাতের ঘুমানোর জন্য খরচ পরবে ৩৫ সুইস ফ্রাঙ্ক। যে ক’দিন থাকবেন তার বুকিং শেষ করে ব্যাগটা রেখে বেরিয়ে পড়ুন ক্যামেরা নিয়ে। বামদিকে ১০০ মিটার গেলে দেখতে পাবেন বিশাল লেক। মুলত এটাই জেনেভা শহরের মুল টুরিস্ট আকর্ষণ।
আপনি যে টিকেটটা কিনেছেন ঐটা দিয়ে বোটে ঘুরতে পারেন ঘণ্টা খানেক। “জেতদি উ” ইংরেজিতে বলে [Jet d'Eau] খবু কাছে থেকে দেখতে পাবেন। ঘণ্টা পেরুলে যে পাড় দিয়ে বোটে উঠেছিলেন তার উলটা পাড়ে নেমে পড়ুন, একটু হাঁটলেই পাবেন শপিং স্ট্রিট। ভাগ্য ভাল থাকলে পেয়ে যাবেন হলিউডি কিংবা বলিউডি কাউকে আম জনতার ভিড়ে। উইক এন্ডে হাঁটার সময় আমি একটা জিনিস আবিষ্কার করেছি, হরেক রকমের টুরিস্ট দেখতে পাবেন এখানে, প্রচণ্ড গরমেও আরাবিয়ান মেয়েদের শুধু চোখ ছাড়া কিছু দেখা যায়না। আবার ভাল করে দেখলে ইউরোপিও মেয়েদের সব কিছুই দেখা যায় কিন্তু চোখ দেখা যায়না (কারণ তাদের চোখ সানগ্লাস দিয়ে ঢাকা থাকে, বাকি কিছু কিছু জায়গা ঢাকা থাকে তবে সেই পুরনো দিনের মসলিন কাপড় দিয়ে).
এরই মাঝে ক্ষুধা লেগে গেলে ম্যকডোনাল্ড থেকে একটা বিগ ম্যক (১০সুইস ফ্রাঙ্ক) ট্রাই করতে পারেন। মনে রাখবেন, সুইজারল্যান্ডে একমাত্র ম্যকডোনাল্ডই সবচেয়ে কমদামে খাবার সার্ভ করে। প্রথমবার, ২০০৯ সালে সুইজারল্যান্ডে বেড়াতে এসে ভারতীয় হোটেল দেখে ভাত খেয়ে ৪২ সুইস ফ্রাঙ্ক বিল দেবার পর পশ্চাৎদেশের চামড়ার জ্বলন এখনো মাঝে মাঝে টের পাই (বিশেষ করে ‘বলিউড টেস্ট’ দোকানটার সামনে দিয়ে যাবার সময়)। তাই ভাত খাওয়া নিতান্তই জরুরি না হলে ভারতীয় রেস্তরাঁয় যাওয়ার প্রয়োজন নেই।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে ওদের পুরনো শহরটা ঘুরে দেখতে পারেন,ওল্ড টাউন শপিং স্ট্রিটের খুব কাছে, তাই কোন বাসে ট্রামে ওঠতে হবেনা। পুরনো শহরে বেশ কটা চার্চ আর মিউজিয়াম আছে ওদের ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি নিয়ে। ক্লান্ত লাগলে পার্ক দি বাস্তিঅনে একটু জিরিয়ে নিতে পারেন।
চলুন এবার জাতিসংঘ এরিয়া থেকে ঘুরে আসি, জাতিসংঘের মোট ৮টি সদর দপ্তর আছে এই এরিয়াতে, তাদের মাঝে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিশ্ব জলবায়ু সংঘ-সহ আরও অনেক। কিছুক্ষণ সময় লাগবে বাংলাদেশের পতাকাটা খুঁজে পেতে, কারণ এখানে বিশ্বের সব দেশের পতাকা আছে। তাড়াতাড়ি পেয়ে গেলে আপনি ভাবতে পারেন আপনি বেশ মেধাবী, কারণ আমি যাদেরকে এই পর্যন্ত ঘুরতে নিয়ে আসেছি তাদের কেউই ঘণ্টা খানেক চেষ্টা করেও খুঁজে পায়নি। (আমি নিজেও পাইনি, তাই এক মামাকে ধরে জেনে নিয়েছি। কিন্তু বন্ধুদের বলেছি আমার প্রথমবারে মাত্র ১০ মিনিট লেগেছে)।
হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত লাগলে চলুন একটা বিয়ার পান করি। ১৩, ১৪, ১৫ নাম্বার যেকোনো একটা ট্রাম ধরে জংশন নামে একটা স্টেশনে নামতে হবে, বিয়ার পানের জন্য এর চেয়ে ভালো জায়গা হতেই পারেনা। কারণ এখানে ভাসমান রেস্তরাঁর মত একটা রেস্তরাঁ আছে যার দুই পাশ দিয়ে রোঁন নদী প্রবাহিত, এখানকার ট্যাপ বিয়ার অসাধারণ। হাফ লিটারের একটা বিয়ারে ২ ইঞ্চি ফোম থাকে। জুতা জোড়া খুলে পা দুটো নদীর পানিতে ভিজিয়ে রেখে বিয়ারের ফোমে মুখ দিয়ে দেখুন কি ভয়াবহ রকম ভাল লাগে। বিয়ার ভাল না লাগলে একটা ননএলকোহলিক ককটেল ট্রাই করতে পারেন, এক্ষেত্রে আপনাকে বলতে হবে “উন ককটেল পা এলকোহল সিল ভু প্লে” অথবা দুইবার এলকোহল হারাম হারাম বললেই ওরা বুঝে যাবে, কারন ওরা আরাবিয়ান টুরিস্ট দেখতে দেখতে অভ্যস্ত।
বিয়ার শেষে একটু ঝিমুনি আসতে পারে কিন্তু সমস্যা হবার কথা না, তাছাড়া রাতের খাবারের জন্য একটা ওয়ার্মআপ হয়ে যাবে। এবার চলুন একটা সুইস ডিশ ট্রাই করা যাক রাতের ডিনারের জন্য। দুই পাশের কোন একটা দোকানে ঢুকে ”বনজুর জে ভুদ্রে উন রেক্লেত সিল ভু প্লে“ বললে হাসি মুখে আপনাকে রেক্লেত দিয়ে যাবে।।
খাবার দাবার শেষে ইচ্ছে হলে একটা জার্মান কিংবা বেলজিয়ান আইছক্রিম নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ইউথ হোস্টেলে চলে যান। যাবার সময় জেতদি উর বিভিন্ন রকম লাইটিং উপভোগ করতে পারেন, তবে বেশিক্ষণ রাত জাগা ঠিক হবেনা, আপনার ঘুমনো প্রয়োজন, কারন কাল সকালে আমি আপনাকে “সেলেভ মাউন্টেনে” নিয়ে যাব, যেখানে যেতে হবে কেব্ল কারে চড়ে, তাছাড়া প্যারাসুট জাম্পিং আর জেনেভা লেকে সুইমিং তো এখনো বাকি। সব শেষে সময় হলে আপনাদের জেনেভা নাইট লাইফ একটু দেখায়ে দিব।(তবে শর্ত সাপেক্ষেঃ দেশে গিয়ে নাইট লাইফের গল্প পুরোপুরি চাইপ্পা যাইতে হবে)।
মাহমুদ
mahmud.geneva@gmail.com
No comments:
Post a Comment